জমি কেনার আগে যে ১১টি বিষয় অবশ্যই যাচাই করবেন

সম্প্রীতি বাংলাদেশ
August 1, 2025
জমি কেনার আগে যে ১১টি বিষয় অবশ্যই যাচাই করবেন

জমি কেনা প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি স্বপ্ন এবং অন্যতম সেরা বিনিয়োগ। কিন্তু এই বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সময় সামান্য একটি ভুল আপনার সারা জীবনের সঞ্চয়কে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে, এমনকি আপনাকে জড়িয়ে ফেলতে পারে দীর্ঘমেয়াদী আইনি জটিলতায়। জমি কেনা মানে শুধু টাকা দেওয়া এবং দলিল রেজিস্ট্রি করা নয়; এর আগে এবং পরে রয়েছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

আজকের এই লেখায় আমরা "সম্প্রীতি বাংলাদেশ"-এর পক্ষ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চেকলিস্ট তুলে ধরব, যা অনুসরণ করলে আপনি একটি নিষ্কণ্টক ও নির্ভেজাল জমির মালিক হতে পারবেন। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেই ১১টি ধাপ।

মালিকানার সত্যতা ও বৈধতা যাচাই

সর্বপ্রথম কাজ হলো, যিনি জমি বিক্রি করছেন, তিনি আসলেই ওই জমির বৈধ মালিক কিনা তা নিশ্চিত করা। এর জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে জমির মূল দলিলের (Original Deed) ফটোকপি চেয়ে নিন। দলিলে উল্লিখিত নামের সাথে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম মিলিয়ে দেখুন। তিনি যদি উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হন, তবে বণ্টননামা বা ফারায়েজ সার্টিফিকেটও দেখতে চান।

দলিলের ধারাবাহিকতা (Via Deed) পরীক্ষা

বিক্রেতা কীভাবে এই জমির মালিক হলেন, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। একে ভায়া বা পিট দলিল বলা হয়। মূল দলিলের সাথে পূর্বের মালিকদের সকল দলিলের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস মিলিয়ে দেখুন। যদি কোথাও কোনো অসংগতি বা মালিকানার হাতবদলে গ্যাপ থাকে, তবে সেখানে জালিয়াতির ঝুঁকি থাকতে পারে।

খতিয়ান ও পর্চা যাচাই

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ভূমি জরিপ অনুযায়ী খতিয়ান তৈরি হয়েছে। আপনাকে এই সবগুলো খতিয়ানের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে, যাতে জমির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর এবং মালিকানার তথ্যে কোনো গরমিল না থাকে। প্রধান কয়েকটি জরিপ হলো:

সংক্ষিপ্ত রূপপূর্ণ রূপ
CSCadastral Survey
SAState Acquisition Survey
RSRevisional Survey
BSBangladesh Survey (সিটি জরিপ)

নামজারি বা মিউটেশন (Mutation) যাচাই

জমির মালিকানা পরিবর্তনের পর সরকারি রেকর্ডে নতুন মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়াটিই হলো নামজারি। বিক্রেতার নামে জমিটির নামজারি করা আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। নামজারি না থাকলে জমিটি বিক্রি করা আইনত বৈধ নয়। AC (Land) বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে আপনি নামজারির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন।

হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ

জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর নিয়মিত পরিশোধ করা মালিকানার একটি অপরিহার্য প্রমাণ। বিক্রেতার কাছে জমির হালনাগাদ খাজনার রশিদ চেয়ে নিন। যদি দীর্ঘদিন ধরে খাজনা বকেয়া থাকে, তবে এর পেছনে কোনো আইনি জটিলতা লুকিয়ে থাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে আপনি বকেয়া খাজনার পরিমাণ সম্পর্কেও জানতে পারবেন।

জমির সরেজমিন পরিদর্শন

কাগজপত্র যাচাই করার পাশাপাশি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমির বাস্তব অবস্থা দেখা অত্যন্ত জরুরি। দলিলের ম্যাপ বা নকশা অনুযায়ী জমির অবস্থান, চৌহদ্দি (সীমানা), এবং মোট পরিমাণ ঠিক আছে কিনা তা একজন দক্ষ সার্ভেয়ার বা আমিনের মাধ্যমে মেপে নিন। জমির পাশে রাস্তা, স্কুল, মসজিদ বা অন্যান্য কী কী সুবিধা-অসুবিধা আছে, তাও পর্যবেক্ষণ করুন।

জমিটি বন্ধক বা মামলায় জড়িত কিনা তা যাচাই

অনেক সময় বিক্রেতা ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নেওয়ার জন্য জমিটি বন্ধক রাখতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তল্লাশি দিয়ে আপনি জমিটি অন্য কোথাও বিক্রি বা বন্ধক অবস্থায় আছে কিনা তা জানতে পারবেন। এছাড়া, জমিটি নিয়ে কোনো দেওয়ানি মামলা চলমান আছে কিনা, সে বিষয়েও খোঁজ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

জমির শ্রেণী যাচাই

দলিল এবং খতিয়ানে জমির একটি শ্রেণী উল্লেখ থাকে, যেমন: নাল (কৃষিজমি), ভিটি (বাড়ি করার উপযোগী), ডাঙ্গা, পুকুর ইত্যাদি। আপনি যে উদ্দেশ্যে জমিটি কিনছেন, জমির শ্রেণী সেই উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করুন। কৃষিজমি কিনে বাড়ি করতে গেলে আপনাকে পরবর্তীতে শ্রেণী পরিবর্তনের জন্য আবেদন করতে হতে পারে, যা একটি জটিল প্রক্রিয়া।

সরকারি অধিগ্রহণ বা খাসজমির অন্তর্ভুক্তি যাচাই

অনেক সময় রাস্তা, ব্রিজ বা অন্য কোনো সরকারি প্রকল্পের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করে। আপনার কাঙ্ক্ষিত জমিটি এমন কোনো প্রকল্পের আওতায় পড়েছে কিনা, তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (LA Branch) থেকে জেনে নিতে পারেন। এছাড়া, জমিটি কোনো খাস, পরিত্যক্ত বা অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত কিনা, তাও ভূমি অফিস থেকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

নাবালকের অংশ আছে কিনা যাচাই

আপনি যে জমিটি কিনছেন, সেখানে কোনো নাবালক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির অংশ আছে কিনা তা দেখুন। যদি থাকে, তবে আদালতের অনুমতি বা গার্জিয়ানের সম্মতি ছাড়া সেই অংশ কেনা-বেচা বৈধ নয়।

বায়নাপত্র সম্পাদন

সবকিছু যাচাই করে সন্তুষ্ট হওয়ার পর বিক্রেতার সাথে একটি বায়নাপত্র বা বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করুন। ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সম্পাদিত এই চুক্তিতে জমির তফসিল, মোট মূল্য, পরিশোধিত টাকার পরিমাণ এবং বাকি টাকা পরিশোধের সময়সীমা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন।

উপরে উল্লিখিত প্রতিটি ধাপ সময়সাপেক্ষ এবং বেশ জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু আপনার স্বপ্নের বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের ভুল এড়াতে এবং আপনার জমি কেনার পথকে মসৃণ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে "সম্প্রীতি বাংলাদেশ"-এর বিশেষজ্ঞ দল আপনার পাশে আছে। জমির কাগজপত্র যাচাই থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে আমরা আপনাকে দিচ্ছি পেশাদারী এবং নির্ভরযোগ্য সেবা।